ভূমিকা:
বর্তমান যুগকে তথ্য প্রযুক্তির যুগ বা ডিজিটাল যুগ বলা হয়, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কম্পিউটার। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ধাপে, ব্যক্তিগত ব্যবহার থেকে শুরু করে বিশাল শিল্প প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসাক্ষেত্র, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, বিনোদন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থায় কম্পিউটারের অপরিহার্য ভূমিকা অনস্বীকার্য। কম্পিউটার শুধু একটি যন্ত্র নয়, এটি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার যা মানব সমাজের অগ্রগতিতে অবিস্মরণীয় অবদান রাখছে। এই অধ্যায়ে আমরা কম্পিউটারের মৌলিক ধারণা, এর কার্যপ্রণালী, দীর্ঘ বিবর্তনের ইতিহাস এবং বিভিন্ন প্রকারভেদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানব। এই আলোচনা আপনাকে আধুনিক ডিজিটাল বিশ্বের একটি স্পষ্ট চিত্র দিতে সাহায্য করবে।
১.১ কম্পিউটার কী? (What is a Computer?)
সহজ ভাষায়, কম্পিউটার হলো একটি স্বয়ংক্রিয় ইলেকট্রনিক যন্ত্র যা ব্যবহারকারীর দেওয়া ডেটা (Data) বা কাঁচা তথ্য গ্রহণ করে, সেটিকে সুনির্দিষ্ট নিয়মে প্রক্রিয়াকরণ (Process) করে এবং একটি অর্থপূর্ণ ফলাফল (Output) বা তথ্য প্রদান করে। প্রয়োজনে এই ফলাফলকে ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ (Storage) করতে পারে।
"Computer" শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ "Compute" থেকে, যার আভিধানিক অর্থ হলো গণনা করা। প্রাচীনকালে কম্পিউটারের মূল লক্ষ্য ছিল দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে জটিল গাণিতিক সমস্যা সমাধান করা। তবে বর্তমানে এর কার্যকারিতা শুধুমাত্র গণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; এটি একই সাথে অসংখ্য জটিল ও বিচিত্র কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পারে, যা এটিকে একটি বহুমুখী যন্ত্রে পরিণত করেছে।
কম্পিউটারের কাজের প্রক্রিয়াকে প্রধানত চারটি মৌলিক ধাপে ভাগ করা যায়, যা একটি চক্রাকার প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করে:
ইনপুট (Input): এটি হলো কম্পিউটারে ডেটা বা নির্দেশনা প্রবেশ করানোর প্রক্রিয়া। ব্যবহারকারী বিভিন্ন ইনপুট ডিভাইসের (যেমন: কিবোর্ড, মাউস, স্ক্যানার, মাইক্রোফোন) মাধ্যমে কাঁচা তথ্য (যেমন: অক্ষর, সংখ্যা, ছবি, শব্দ) অথবা কোনো নির্দেশ (যেমন: ফাইল খোলা, একটি প্রোগ্রাম চালানো) কম্পিউটারে প্রবেশ করায়। কম্পিউটার এই ডেটা গ্রহণ করে পরবর্তী ধাপের জন্য প্রস্তুত হয়।
প্রসেসিং (Processing): ইনপুট হিসেবে গ্রহণ করা ডেটা বা নির্দেশনাকে সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট (CPU) এর মাধ্যমে বিশ্লেষণ, গণনা এবং পরিবর্তন করার প্রক্রিয়াকে প্রসেসিং বলে। এই ধাপে কম্পিউটার প্রাপ্ত ডেটাকে তার অভ্যন্তরীণ যুক্তি এবং পূর্ব-নির্ধারিত প্রোগ্রাম অনুযায়ী সাজিয়ে, হিসাব করে বা পরিবর্তন করে একটি ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় নিয়ে আসে। এটি কম্পিউটারের "মস্তিষ্ক" হিসেবে কাজ করে।
আউটপুট (Output): প্রক্রিয়াকরণের পর প্রাপ্ত অর্থপূর্ণ ফলাফল বা তথ্যকে ব্যবহারকারীর কাছে প্রদর্শন করার প্রক্রিয়াকে আউটপুট বলে। আউটপুট ডিভাইস (যেমন: মনিটর, প্রিন্টার, স্পিকার) এই ফলাফলকে আমাদের বোধগম্য রূপে উপস্থাপন করে। উদাহরণস্বরূপ, যখন আপনি কিবোর্ডে কিছু টাইপ করেন, তা মনিটরে দেখা যায়; অথবা কোনো ছবি সম্পাদনা করার পর প্রিন্টারে তার ছাপা বের হয়।
স্টোরেজ (Storage): প্রক্রিয়াকরণের পর প্রাপ্ত ফলাফল বা মূল ডেটাগুলোকে ভবিষ্যতের ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করে রাখার প্রক্রিয়া। কম্পিউটার বিভিন্ন স্টোরেজ ডিভাইসে (যেমন: হার্ড ডিস্ক ড্রাইভ, সলিড স্টেট ড্রাইভ, পেনড্রাইভ, মেমরি কার্ড) এই তথ্য স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে জমা রাখে, যাতে পরবর্তীতে প্রয়োজন অনুযায়ী তা পুনরায় ব্যবহার করা যায়।
কম্পিউটার আমাদের স্বাভাবিক ভাষা, যেমন বাংলা বা ইংরেজি, বোঝে না। এটি কাজ করে শুধুমাত্র বাইনারি (Binary) পদ্ধতিতে, যা বিদ্যুতের উপস্থিতি (On) এবং অনুপস্থিতি (Off) দ্বারা পরিচালিত হয়। এই দুটি অবস্থাকে যথাক্রমে ১ এবং ০ দিয়ে প্রকাশ করা হয়। কম্পিউটারে আমরা যা কিছুই ইনপুট করি না কেন—সেটা একটি অক্ষর, একটি ছবি বা একটি গান—কম্পিউটার তার অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেগুলোকে প্রথমে ০ এবং ১-এর বাইনারি সংখ্যায় রূপান্তর করে নেয়। এরপর সমস্ত গণনা, প্রক্রিয়াকরণ এবং ফলাফল প্রদান এই বাইনারি কোড ব্যবহার করেই সম্পন্ন হয়। এটিই কম্পিউটারের মৌলিক কার্যপ্রणाली।
১.২ কম্পিউটার ব্যবহারের সুবিধা (Advantages of Using a Computer)
কম্পিউটার মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও কর্মক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। এর প্রধান কিছু সুবিধা এটিকে মানুষের জন্য অপরিহার্য করে তুলেছে:
গতি (Speed): কম্পিউটারের কাজ করার গতি মানুষের কল্পনারও অতীত। যে কাজটি একজন মানুষের করতে মাস বা বছর লেগে যাবে, একটি শক্তিশালী কম্পিউটার তা মুহূর্তের মধ্যে সম্পন্ন করতে পারে। আধুনিক কম্পিউটারের গতি গিগাহার্টজ (GHz) এককে পরিমাপ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি ৩ গিগাহার্টজ প্রসেসর প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩ বিলিয়ন (৩,০০,০০,০০,০০০) নির্দেশনা বা হিসাব প্রক্রিয়াকরণ করতে সক্ষম। বৈজ্ঞানিক গবেষণা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস বা জটিল মডেলিং এর মতো কাজগুলো এত দ্রুত গতি ছাড়া অসম্ভব।
নির্ভুলতা (Accuracy): কম্পিউটার নিজে থেকে কোনো ভুল করে না। যদি তাকে সঠিক ডেটা এবং নির্ভুল নির্দেশনা দেওয়া হয়, তবে এটি সর্বদা ১০০% নির্ভুল ফলাফল প্রদান করবে। কম্পিউটার বিজ্ঞানের একটি প্রবাদ বাক্য হলো "Garbage In, Garbage Out" (GIGO), যার অর্থ হলো—যদি আপনি ভুল তথ্য বা নির্দেশনা ইনপুট করেন, তবে কম্পিউটারও ভুল ফলাফলই প্রদান করবে। এর অর্থ হলো, কম্পিউটারের ভুল মূলত ব্যবহারকারীর ভুল ডেটা বা প্রোগ্রামিংয়ের ফল।
বিশাল সংরক্ষণ ক্ষমতা (Huge Storage Capacity): কম্পিউটার অতি অল্প স্থানে বিশাল পরিমাণ ডেটা স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করে রাখতে পারে। এটি শুধুমাত্র সংখ্যা বা অক্ষর নয়, ছবি, ভিডিও, অডিও ফাইল, ডকুমেন্ট ইত্যাদি সব ধরনের ডেটা সংরক্ষণ করতে সক্ষম। ডেটা পরিমাপের মৌলিক একক হলো বাইট (Byte)।
১ কিলোবাইট (KB) = ১০২৪ বাইট (একটি ছোট টেক্সট ফাইলের সমান)
১ মেগাবাইট (MB) = ১০২৪ KB (একটি সাধারণ মানের ছবির সমান, বা একটি ছোট গানের সমান)
১ গিগাবাইট (GB) = ১০২৪ MB (একটি পূর্ণাঙ্গ হাই-ডেফিনিশন সিনেমার সমান)
১ টেরাবাইট (TB) = ১০২৪ GB (একটি ব্যক্তিগত লাইব্রেরির সকল বইয়ের ডিজিটাল সংস্করণের সমান)
এর চেয়েও বড় একক রয়েছে যেমন পেটাবাইট (PB), এক্সাবাইট (EB) ইত্যাদি।
অক্লান্ত পরিশ্রম (Diligence): মানুষের মতো কম্পিউটার ক্লান্ত হয় না, বিরক্ত হয় না বা মনোযোগ হারায় না। এটি একটানা ঘণ্টার পর ঘণ্টা, এমনকি দিনের পর দিন একই কাজ নির্ভুলভাবে এবং একই গতিতে করে যেতে পারে। এই বৈশিষ্ট্যটি ফ্যাক্টরি অটোমেশন, ডেটা সেন্টার অপারেশন এবং দীর্ঘমেয়াদী গবেষণার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বহুমুখিতা (Versatility): একটি আধুনিক কম্পিউটার একই সাথে অসংখ্য ভিন্ন ধরনের কাজ সম্পাদন করতে সক্ষম। আপনি এটি দিয়ে লেখালেখি (Word Processing), হিসাব-নিকাশ (Spreadsheet), প্রেজেন্টেশন তৈরি, গ্রাফিক্স ডিজাইন, গান শোনা, সিনেমা দেখা, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, গেম খেলা থেকে শুরু করে জটিল বৈজ্ঞানিক সিমুলেশন এবং প্রোগ্রামিং পর্যন্ত করতে পারেন। এটি একটি একক যন্ত্রকে বিভিন্ন পেশার এবং শখের মানুষের জন্য উপযোগী করে তুলেছে।
স্বয়ংক্রিয়তা (Automation): একবার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা বা প্রোগ্রাম সেট করে দিলে কম্পিউটার মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ফ্যাক্টরিগুলোতে রোবোটিক বাহুগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে জিনিসপত্র সংযোজন করে, যা উৎপাদন প্রক্রিয়াকে দ্রুততর এবং আরও কার্যকর করে তোলে। ব্যাংকিং সিস্টেমে অনলাইন লেনদেন, বিল পেমেন্ট ইত্যাদি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হয়।
১.৩ কম্পিউটারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (A Brief History of Computers)
আজ আমরা যে অত্যাধুনিক কম্পিউটার ব্যবহার করছি, তা রাতারাতি তৈরি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে বহু দশকের গবেষণা, উদ্ভাবন এবং বিভিন্ন প্রজন্মের প্রযুক্তিগত বিবর্তন। এই বিবর্তনের ইতিহাসকে কয়েকটি প্রধান পর্যায়ে ভাগ করা যায়:
প্রাচীন গণনাকারী যন্ত্র (Ancient Computing Devices): কম্পিউটারের ধারণার জন্ম হয় গণনার প্রয়োজন থেকে। প্রায় ৫০০০ বছর আগে চীনে অ্যাবাকাস (Abacus) আবিষ্কৃত হয়, যা ছিল প্রথম পরিচিত গণনাকারী যন্ত্র। এর মাধ্যমে যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ ইত্যাদি কাজ করা যেত। এটিই কম্পিউটারের প্রাচীনতম পূর্বপুরুষ হিসেবে পরিচিত। এরপর ১৭শ শতাব্দীতে জন নেপিয়ার, ব্লেইজ পাসকাল এবং গটফ্রিড ভন লিবনিজ বিভিন্ন যান্ত্রিক গণনাকারী যন্ত্র আবিষ্কার করেন।
যান্ত্রিক কম্পিউটার যুগ (Mechanical Computer Era): ১৮২২ সালে ইংরেজ গণিতবিদ এবং উদ্ভাবক চার্লস ব্যাবেজ (Charles Babbage) একটি স্বয়ংক্রিয় যান্ত্রিক গণনাকারী যন্ত্র "ডিফারেন্স ইঞ্জিন (Difference Engine)" এর নকশা করেন। এটি সফলভাবে তৈরি করা সম্ভব হয়নি। তবে, ১৮৩০ এর দশকে তিনি আরও উন্নত এবং সাধারণ-উদ্দেশ্যের একটি যন্ত্র "অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন (Analytical Engine)" এর ধারণা দেন। এই যন্ত্রটিতে আধুনিক কম্পিউটারের অনেক মৌলিক উপাদান (যেমন: ALU, Control Flow, Integrated Memory) ছিল। এজন্য চার্লস ব্যাবেজকে "কম্পিউটারের জনক" (Father of the Computer) বলা হয়। তার সহযোগী, কবি লর্ড বায়রনের কন্যা অ্যাডা লাভলেস (Ada Lovelace), অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের জন্য প্রথম অ্যালগরিদম বা প্রোগ্রাম তৈরি করেন, যা তাকে বিশ্বের প্রথম প্রোগ্রামার হিসেবে স্বীকৃতি এনে দেয়।
প্রথম প্রজন্ম (First Generation, 1946-1959): এই প্রজন্মের কম্পিউটারগুলোতে প্রধান প্রযুক্তি হিসেবে ভ্যাকুয়াম টিউব (Vacuum Tube) ব্যবহৃত হতো। এগুলো ছিল আকারে বিশাল (একটি ঘরের সমান), অত্যন্ত ব্যয়বহুল, অত্যন্ত ধীরগতিসম্পন্ন এবং প্রচুর পরিমাণে তাপ উৎপন্ন করত, যার জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হতো। ডেটা সংরক্ষণের জন্য ম্যাগনেটিক ড্রাম ব্যবহার করা হতো। ENIAC (Electronic Numerical Integrator and Computer) ছিল এই প্রজন্মের অন্যতম বিখ্যাত কম্পিউটার, যা ১৯৪৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি হয়। এর ওজন ছিল প্রায় ৩০ টন এবং এটি প্রায় ১৮,০০০ ভ্যাকুয়াম টিউব দ্বারা গঠিত ছিল। এই প্রজন্মের কম্পিউটারগুলো মূলত বৈজ্ঞানিক এবং সামরিক হিসাব-নিকাশের জন্য ব্যবহৃত হতো।
দ্বিতীয় প্রজন্ম (Second Generation, 1959-1965): ১৯৪৮ সালে ট্রানজিস্টর (Transistor) আবিষ্কার কম্পিউটারের ইতিহাসে একটি বিপ্লব নিয়ে আসে। ভ্যাকুয়াম টিউবের পরিবর্তে ট্রানজিস্টর ব্যবহারের ফলে কম্পিউটার আকারে অনেক ছোট, দ্রুততর, সস্তা, অধিক নির্ভরযোগ্য এবং কম বিদ্যুৎ খরচকারী হয়ে ওঠে। এই প্রজন্মের কম্পিউটারগুলোতে হাই-লেভেল প্রোগ্রামিং ভাষা (যেমন: FORTRAN, COBOL) ব্যবহার শুরু হয়, যা প্রোগ্রামিংকে আরও সহজ করে তোলে। ডেটা সংরক্ষণের জন্য ম্যাগনেটিক কোর মেমরি ব্যবহৃত হতো।
তৃতীয় প্রজন্ম (Third Generation, 1965-1971): এই প্রজন্মে ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (Integrated Circuit - IC) বা চিপ (Chip) এর ব্যবহার শুরু হয়। রবার্ট নয়েস এবং জ্যাক কিলবি স্বাধীনভাবে ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট আবিষ্কার করেন। একটি ছোট সিলিকন চিপের মধ্যে হাজার হাজার ট্রানজিস্টর এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক উপাদান যুক্ত করে কম্পিউটারের আকার নাটকীয়ভাবে ছোট করা হয় এবং একই সাথে কার্যক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এই সময়ে অপারেটিং সিস্টেমের ধারণা বিকশিত হয়, যা কম্পিউটারকে মাল্টিটাস্কিংয়ে (একই সাথে একাধিক কাজ করা) সক্ষম করে তোলে।
চতুর্থ প্রজন্ম (Fourth Generation, 1971-বর্তমান): এই প্রজন্মের মূল চালিকাশক্তি হলো মাইক্রোপ্রসেসর (Microprocessor)। ১৯৭০-এর দশকে একটি একক সিলিকন চিপের মধ্যে সম্পূর্ণ সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট (CPU) যুক্ত করে মাইক্রোপ্রসেসর তৈরি করা হয়। ১৯৭১ সালে ইন্টেল (Intel) কর্পোরেশন বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক মাইক্রোপ্রসেসর "Intel 4004" বাজারে আনে। এই উদ্ভাবনই পার্সোনাল কম্পিউটার (PC) বা ব্যক্তিগত কম্পিউটারের ধারণাকে বাস্তব রূপ দেয়। ১৯৭৭ সালে স্টিভ জবস ও স্টিভ ওজনিয়াকের অ্যাপল (Apple) কম্পিউটার এবং ১৯৮১ সালে আইবিএম (IBM) তাদের পার্সোনাল কম্পিউটার বাজারে নিয়ে আসে, যা কম্পিউটারকে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে পৌঁছে দেয় এবং ডিজিটাল বিপ্লবের সূচনা করে। এই প্রজন্মের কম্পিউটারগুলোতে গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস (GUI), মাউস এবং নেটওয়ার্কিং প্রযুক্তির বিকাশ ঘটে।
পঞ্চম প্রজন্ম (Fifth Generation, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ): এই প্রজন্ম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence - AI), কোয়ান্টাম কম্পিউটিং (Quantum Computing) এবং ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং (Natural Language Processing) এর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠছে। এই প্রজন্মের কম্পিউটারগুলো মানুষের মতো চিন্তা করতে, শিখতে, সিদ্ধান্ত নিতে এবং মানুষের ভাষার সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হবে বলে ধারণা করা হয়। আজকের স্মার্টফোন, ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট (যেমন গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট, সিরি, অ্যালেক্সা), ফেসিয়াল রিকগনিশন (মুখ চেনার প্রযুক্তি) এবং স্বয়ংক্রিয় গাড়ি এই প্রজন্মের প্রযুক্তিরই প্রাথমিক ফসল। ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তির আরও ব্যাপক বিকাশ ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে।
১.৪ কম্পিউটারের প্রকারভেদ (Types of Computers)
কম্পিউটার বিভিন্ন আকার, ক্ষমতা এবং ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। এদেরকে প্রধানত চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়:
সুপারকম্পিউটার (Supercomputer):
বৈশিষ্ট্য: এটি হলো বর্তমানে উপলব্ধ সবচেয়ে শক্তিশালী, দ্রুতগতির এবং ব্যয়বহুল কম্পিউটার। এগুলি প্রতি সেকেন্ডে বিলিয়ন বিলিয়ন (1018 বা তারও বেশি) হিসাব করতে সক্ষম, যাকে ফ্লোটিং পয়েন্ট অপারেশনস পার সেকেন্ড (FLOPS) দ্বারা পরিমাপ করা হয়।
ব্যবহার: জটিল বৈজ্ঞানিক গবেষণা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস মডেলিং, পারমাণবিক শক্তি গবেষণা, তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান, মহাকাশ বিজ্ঞান, জেনেটিক্স, জটিল সিমুলেশন এবং ক্রিপ্টোগ্রাফি (গোপন তথ্য এনক্রিপশন) এর মতো কাজে এটি ব্যবহৃত হয়। বিশ্বের দ্রুততম সুপারকম্পিউটারগুলোর মধ্যে ফ্রন্টিয়ার (Frontier) এবং ফুগাকু (Fugaku) উল্লেখযোগ্য।
মেইনফ্রেম কম্পিউটার (Mainframe Computer):
বৈশিষ্ট্য: সুপারকম্পিউটারের চেয়ে কিছুটা কম শক্তিশালী হলেও, মেইনফ্রেম কম্পিউটারগুলো অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য, স্থিতিশীল এবং একই সাথে হাজার হাজার ব্যবহারকারীকে (টার্মিনাল) পরিষেবা দিতে পারে। এদের বিশাল স্টোরেজ ক্ষমতা এবং ডেটা প্রসেসিং ক্ষমতা রয়েছে।
ব্যবহার: ব্যাংক, বীমা কোম্পানি, সরকারি সংস্থা, এয়ারলাইন্স এবং বড় কর্পোরেশনগুলো তাদের বিশাল ডেটা প্রসেসিং, লেনদেন, গ্রাহক ডেটাবেস পরিচালনা এবং গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপ্লিকেশন চালানোর জন্য মেইনফ্রেম ব্যবহার করে। যেমন, যখন আপনি এটিএম থেকে টাকা তোলেন, তখন একটি মেইনফ্রেম কম্পিউটার আপনার লেনদেন প্রক্রিয়া করে।
মিনিকম্পিউটার (Minicomputer):
বৈশিষ্ট্য: এটি মেইনফ্রেমের চেয়ে ছোট এবং কম শক্তিশালী, কিন্তু মাইক্রোকম্পিউটারের চেয়ে বড় ও অধিক শক্তিশালী। এদের দাম মেইনফ্রেমের চেয়ে কম এবং ছোট ও মাঝারি আকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এটি একটি সাশ্রয়ী সমাধান।
ব্যবহার: মূলত সার্ভার (Server) হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেখানে এটি একটি নির্দিষ্ট বিভাগ বা একটি ছোট সংস্থার নেটওয়ার্ক সমর্থন করে। ডেটাবেস ব্যবস্থাপনা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাপ্লিকেশনগুলিতে এটি ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে এদের ব্যবহার কিছুটা কমেছে কারণ শক্তিশালী সার্ভার-ক্লাস মাইক্রোকম্পিউটারগুলো অনেক মিনিকম্পিউটারের কাজ করতে পারে।
মাইক্রোকম্পিউটার (Microcomputer):
বৈশিষ্ট্য: ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য ডিজাইন করা সবচেয়ে সাধারণ ধরনের কম্পিউটার। এগুলি আকারে ছোট, তুলনামূলকভাবে সস্তা এবং সহজেই বহনযোগ্য বা স্থাপনযোগ্য। একটি একক মাইক্রোপ্রসেসর ব্যবহার করে এদের মূল কার্য সম্পন্ন হয়।
প্রকারভেদ:
ডেস্কটপ কম্পিউটার (Desktop Computer): যা সাধারণত একটি ডেস্কের উপর রেখে ব্যবহার করা হয়। এর সিপিইউ, মনিটর, কিবোর্ড, মাউস ইত্যাদি অংশগুলো আলাদা আলাদা থাকে। এগুলি সাধারণত আপগ্রেড করা সহজ এবং ভালো পারফরম্যান্স প্রদান করে।
ল্যাপটপ কম্পিউটার (Laptop Computer): এটি সহজে বহনযোগ্য এব